( সুত্রপিটক / ৩. সংযুক্ত নিকায় / ১. সগাথাবর্গ / ১০. যক্ষ সংযুক্ত / ১. ইন্দক সুত্র )
২৩৫. আমি এরূপ শুনেছি, এক সময় ভগবান রাজগৃহের ইন্দ্রকূট পর্বতে ইন্দক নামক যক্ষের ভবনে অবস্থান করছিলেন। তখন ইন্দক যক্ষ ভগবান যেখানে অবস্থান করছিলেন সেখানে উপস্থিত হয়ে গাথায় বলল,
ইন্দ্রকূট পর্বতে বসবাসকারী এই যক্ষটি মহাপ্রভাবশালী দলনেতা বলে তার নাম হয়েছিল ইন্দ বা ইন্দ্র। একারণে সে ইন্দক নামেও পরিচিত ছিল।
বুদ্ধগণ বলেন, দেহ নাকি জীব নয়।
তাহলে কীভাবে এই শরীর লাভ হয়ে থাকে?
কোত্থেকে হাড়-মাংসের দলা আসে?
কীভাবে এটি মাতৃগর্ভে লেগে থাকে?
দেহ নাকি জীব নয় অর্থাৎ দেহ নাকি কোনো প্রাণি নয়, ব্যক্তি নয়। তাহলে কোত্থেকে হাড়-মাংসের দলা আসে? এখানে হাড় বলতে তিনশ হাড় এবং মাংসপিণ্ড বলতে নয়শ মাংসপেশিকে বুঝিয়েছে। দেহ যদি জীব বা প্রাণি না হয় তাহলে এই হাড় ও মাসংপেশিগুলো কোত্থেকে আসে?
কীভাবে এটি মাতৃগর্ভে লেগে থাকে? এর মানে হচ্ছে, কোন কারণে এই সত্ত্বটি মাতৃগর্ভে লেগে থাকে, টিকে থাকে? এই যক্ষটি নাকি ব্যক্তিবাদী বা আত্মবাদী ছিল, অর্থাৎ সে বিশ্বাস করত যে ব্যক্তি বা আত্মা বলে একটা কিছু আছে। তার ধারণা ছিল, সত্ত্বরা একবারেই মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে থাকে। কারণ কোনো মাতা যেসব মাছ মাংস ইত্যাদি খাদ্য খেয়ে থাকে সেগুলো সবই একরাত হলেই পচে গিয়ে ফেনার বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে যায়। সেই মাতার গর্ভস্থ সন্তানের দেহ যদি কোনো সত্ত্ব না হত, তাহলে সেটাও নিশ্চয়ই এসব খাদ্যের মতো পচেগলে বিলীন হয়ে যেত।
প্রাণিরা মায়ের গর্ভে একবারেই পরিপূর্ণভাবে জন্মায় না। বরং ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠে। সেটা বুঝানোর জন্য বুদ্ধ নিচের গাথাগুলো বলেন-
প্রথমে কলল হয়,
কলল থেকে হয় অর্বুদ।
অর্বুদ থেকে হয় পেশি,
পেশি থেকে হয় ঘন।
ঘন থেকে শাখাপ্রশাখা হয়ে
কেশ, লোম ও নখ গজায়।
এখানে প্রথমে মানে হচ্ছে মাতৃগর্ভে প্রথম প্রতিসন্ধি বিজ্ঞান উৎপত্তির সময়ে, অর্থাৎ এই জন্মের প্রথম চিত্ত উৎপত্তির সময়ে। সেই চিত্তের সাথে করে অমুক বা সমুক নামের কেউ আসে না বা জন্মায় না। বরং কোনো ভেড়ার পেট চিরে বের করে আনা সদ্যজাত বাচ্চা ভেড়ার গায়ে যে লোম থাকে, এমন তিনটা লোম দিয়ে সুতা তৈরী করলে সেই সুতার আগায় যে তেলের ফোঁটা ঝুলে থাকে, সেই তেলের ফোঁটার পরিমাণে কলল হয়। এতটুকু পরিমাণের কললকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে,
তিলের তেলের ফোঁটা যেমন,
অনাবিল উৎকৃষ্ট ঘি
এমন রং ও আকারের হলে
সেটাকে কলল বলা হয়।
জন্মের শুরুতে দেহটা মাতৃগর্ভে প্রথমে এমন রং ও আকারে কলল হিসেবে উৎপন্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে সেটা হয় পদার্থের একটা পুঞ্জ, মৌলিক ও যৌগিক কণাগুলোর ক্রমাগত উৎপন্ন হয়ে চলার প্রবাহ।
কলল থেকে হয় অর্বুদ এর অর্থ হচ্ছে, সেই কলল এক সপ্তাহ পরে মাংস ধোয়া পানির রংয়ের মতো হয়। কিন্তু আকার হয় গলিত সীসার মত। তখন এর নাম হয় অর্বুদ। একারণে বলা হয়েছে-
কলল যখন এক সপ্তাহ হয়,
তখন তা পরিপক্ক হয়।
সৃষ্টি হতে থাকা সেই অবস্থাকে,
অর্বুদ নাম দেয়া হয়।
অর্বুদ থেকে হয় পেশি এর অর্থ হচ্ছে, সেই অর্বুদ এক সপ্তাহ পরে আকারে গলিত সীসার মতো হয়। কিন্তু রং হয় সাদা, বর্ণহীন। তখন এর নাম হয় পেশি। সেটাকে বুঝতে হবে মরিচগুঁড়োর মতো করে। গ্রামের কন্যা পাকা মরিচ নিয়ে কাপড়ে পোঁটলা বেঁধে সেগুলোকে পিষ্ট করে। তারপর সেই মরিচগুঁড়ো একটা পাত্রে নিয়ে রোদে রেখে দেয়। সেই মরিচের গুঁড়ো শুকিয়ে গেলে পাত্রের উপর একদলা বা একটা পিণ্ডের মতো হয়ে যায়। পাত্রের গায়ে আর লেগে থাকে না। ঠিক তেমনিভাবে সেই পেশিও মাতৃগর্ভে কোথাও লেগে না থাকে একদলা বা একটি পিণ্ডের মতো হয়ে থাকে। একারণে বলা হয়েছে-
অর্বুদ যখন এক সপ্তাহ হয়,
তখন তা পরিপক্ক হয়।
সৃষ্টি হতে থাকা সেই অবস্থাকে,
পেশি নাম দেয়া হয়।
পেশি থেকে হয় ঘন এর অর্থ হচ্ছে, সেই পেশি এক সপ্তাহ পরে মুরগির ডিমের আকারের মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। তখন এর নাম হয় ঘন। একারণে বলা হয়েছে-
পেশি যখন এক সপ্তাহ হয়,
তখন তা পরিপক্ক হয়।
সৃষ্টি হতে থাকা সেই অবস্থাকে,
পেশি নাম দেয়া হয়।
মুরগির ডিম যেমন
চারদিকে গোলাকার,
কর্মের কারণে সেই ঘনের
আকারও হয় ঠিক সেরকম।
ঘন থেকে শাখাপ্রশাখা হয়ে এর অর্থ হচ্ছে, পঞ্চম সপ্তাহে হাত পা এবং মাথার জন্য পাঁচটা ফোঁড়ার মতো মাংসপিণ্ড গজিয়ে ওঠে। যাকে ভিত্তি করে বলা হয়েছে, ‘হে ভিক্ষুগণ, পঞ্চম সপ্তাহে কর্মের প্রভাবে পাঁচটা ফোঁড়া গজিয়ে ওঠে।’
এরপর ষষ্ঠ, সপ্তম ইত্যাদি আর উল্লেখ না করে দেশনা সংক্ষিপ্ত করে বেয়াল্লিশতম সপ্তাহের পরিপূর্ণ গর্ভস্থ সন্তানের অবস্থাকে দেখিয়ে কেশ, লোম ইত্যাদির কথা বলেছেন। সাধারণত নয় মাস হয়ে গেলে সেটাকে পরিপূর্ণ গর্ভ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে, কারণ তখন চুল, লোম ইত্যাদি গজায়। তাই বলা হয়েছে, কেশ, লোম ও নখ গজায়। এগুলো গজায় বেয়াল্লিশতম সপ্তাহে।
মা যে অন্ন-পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য খায়,
তার দ্বারাই মাতৃগর্ভস্থ ব্যক্তি
জীবন ধারণ করে।
তার দ্বারাই মাতৃগর্ভস্থ ব্যক্তি জীবন ধারণ করে অর্থাৎ সেই মাতৃগর্ভস্থ শিশুর নাভি থেকে উৎপন্ন হওয়া নল মায়ের পাকস্থলীর গায়ের সাথে সংযুক্ত থাকে। সেই নল হয় পদ্মনলের মতো ছিদ্রবিশিষ্ট। সেই নলের মাধ্যমে খাদ্যরস বা পুষ্টি এসে শিশুর শরীরে আহারজ রূপ বা পুষ্টিজাত পদার্থ উৎপন্ন করে থাকে। সেই পুষ্টিজাত পদার্থ হয় মূলত ওজঅষ্টমক রূপকলাপ বা পুষ্টিজাত অষ্টক কণা। এভাবে শিশু দশমাস মায়ের গর্ভে কাটায়।