(অভিধর্মপিটক / ধর্মসঙ্গণী / ১. চিত্তের উৎপত্তি অধ্যায় => কামাবচর কুশল পদগুলোর বিশ্লেষণ)
১৫৬-১৫৯.
পুণ্যকাজের বিষয়গুলোর কথা1
১৬০-৫৭৭.
—অর্থকথা ও টীকার ব্যাখ্যাবলী—
-
পুণ্যকাজের বিষয়গুলোর কথা
সেই সবগুলো চিত্তকে দশটি পুণ্যকাজের বিষয়গুলোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা উচিত। কীভাবে? দানময় পুণ্যকাজের বিষয়, শীলময় পুণ্যকাজের বিষয়, ভাবনাময় পুণ্যকাজের বিষয়, সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকাজের বিষয়, সেবা সংশ্লিষ্ট পুণ্যকাজের বিষয়, পুণ্য প্রদানের পুণ্যকাজের বিষয়, অনুমোদনের পুণ্যকাজের বিষয়, দেশনাময় পুণ্যকাজের বিষয়, শ্রবণময় পুণ্যকাজের বিষয়, দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী কর্মের পুণ্যকাজের বিষয়। এই হচ্ছে দশটি পুণ্যকাজের বিষয়। এখানে দানই হচ্ছে দানময়। দান একটা পুণ্যকাজ এবং সেই সেই সুফলগুলোর ভিত্তি বলে সেটাকে পুণ্যকাজের বিষয় বলা হয়ে থাকে। বাকি পুণ্যকাজের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকমের।
চারি প্রত্যয়, যেমন – চীবর, ভিক্ষান্ন, আবাস, ওষুধপত্র এই চার প্রকার দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি, ছয় আলম্বন, যেমন- রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, মানসিক বিষয় এই ছয় প্রকার বিষয়বস্তুর প্রতি, দশ দানীয়বস্তু, যেমন – অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যানবাহন, মালা, সুগন্ধি, প্রলেপন, শয্যা বা বিছানা, আবাস, প্রদীপ এই দশ প্রকার দানীয় বস্তুর প্রতি, দানের উদ্দেশ্যে সেগুলোর সংগ্রহ থেকে শুরু করে দানের আগে, পরিত্যাগের সময়ে এবং দানের পরে খুশিমনে স্মরণকালে এই তিন কালে চলতে থাকা চেতনাগুলোই হচ্ছে দানময় পুণ্যকাজের বিষয়।
পঞ্চশীল, অষ্টশীল ও দশশীল গ্রহণের সময়ে, ‘প্রব্রজিত হবো’ এই মন নিয়ে বিহারে গমনের সময়ে, প্রব্রজ্যার সময়ে, ‘মনস্কামনা পূর্ণ হলো, আমি এখন প্রব্রজিত, সাধু সাধু’ এভাবে পর্যালোচনার সময়ে, পাতিমোক্ষ সংবরণের সময়ে, চীবর ইত্যাদি জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রত্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনার সময়ে, দৃষ্টিপথে রূপ ইত্যাদি আসলেও চোখ ইত্যাদি দ্বারগুলো সংযত রাখার সময়ে, জীবিকা পরিশুদ্ধ করার সময়ে চলমান চেতনাগুলো হচ্ছে শীলময় পুণ্যকাজ।
প্রতিসম্ভিদায় উল্লেখিত বিদর্শনপদ্ধতিতে চোখকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে … মনকে … রূপগুলোকে … ধর্ম বা মানসিক বিষয়গুলোকে … চোখবিজ্ঞানকে … মনোবিজ্ঞানকে … চোখসংস্পর্শকে … মনসংস্পর্শকে … চোখসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … মনসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … রূপসংজ্ঞাকে … জরামরণকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো, অথবা আটত্রিশটি ভাবনার বিষয়ে অর্পণায় না পৌঁছানো পর্যন্ত সবগুলো চেতনা হচ্ছে ভাবনাময় পুণ্যকাজ।
বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষুদেরকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তাদের পাত্রচীবর গ্রহণ করা, অভিবাদন করা, রাস্তা করে দেয়া ইত্যাদিকে সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকাজ বলে বুঝতে হবে।
বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি করণীয় ব্রত আচরণকারী হিসেবে গ্রামে পিণ্ডচারণের জন্য প্রবেশ করা ভিক্ষুকে দেখে পাত্র নিয়ে গ্রামে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করিয়ে তুলনা করার জন্য ‘যাও, ভিক্ষুদের পাত্রগুলো আনো’ শুনে দ্রুত গিয়ে পাত্র নিয়ে আসা ইত্যাদির মাধ্যমে কায়িক সেবা দানকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো সেবাসংশ্লিষ্ট পুণ্যকাজ বলে বুঝতে হবে।
দান দিয়ে, সুগন্ধি ইত্যাদি দ্বারা পূজা করে ‘অমুকের পুণ্য হোক’ অথবা ‘এই পুণ্য সকল সত্ত্বের হোক’ এভাবে পুণ্য দান করাকেই পুণ্যপ্রদানের পুণ্যকাজ বলে বুঝতে হবে। এভাবে পুণ্য ভাগ দিলে কি পুণ্য ক্ষয় হয়? হয় না। যেমন একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে তা থেকে হাজারো প্রদীপ জ্বালালেও প্রথম প্রদীপকে অনুজ্জ্বল বলা যায় না, বরং তখন প্রথম প্রদীপের আলোর সাথে পরবর্তী প্রদীপগুলোর আলোও একত্রিত হয়ে বিশাল আলো হয়ে ওঠে। এভাবেই পুণ্য বিতরণকালে কোনো ক্ষতি নেই, বরং লাভই হয় বলে বুঝতে হবে।
অন্যের দেয়া পুণ্য অথবা অন্যের পুণ্যকাজের প্রতি ‘সাধু সাধু’ বলে অনুমোদন বা সমর্থনের মাধ্যমে অনুমোদনের পুণ্যকাজ হয় বলে বুঝতে হবে।
কেউ কেউ ‘এভাবে আমাকে সবাই ধর্মীয় বক্তা হিসেবে জানবে’ এই ইচ্ছায় লাভপ্রত্যাশী হয়ে ধর্মদেশনা করে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ কোনো প্রত্যাশা না করে বিমুক্তিকে মাথায় রেখেই নিজের সুপরিচিত ধর্মকে অন্যের কাছে দেশনা করে, সেটাই হচ্ছে দেশনাময় পুণ্যকাজ।
কেউ কেউ দেশনা শুনতে শুনতে ‘এভাবে আমাকে সবাই শ্রদ্ধাবান বলে জানবে’ মনে এমন ভাব নিয়ে দেশনা শোনে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ ‘এভাবে আমার মহাফল লাভ হবে’ এভাবে মঙ্গলাকাঙ্খী হয়ে মৃদু কোমল চিত্ত নিয়ে ধর্মদেশনা শোনে, সেটাই হচ্ছে শ্রবণময় পুণ্যকাজ।
দৃষ্টিভঙ্গি বা ধ্যানধারণা সোজা করতে থাকলে তা হয় ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী কর্মের পুণ্যকাজ’। দীর্ঘনিকায় আবৃত্তিকারকেরা কিন্তু বলে থাকেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী কর্মের সবগুলোই হচ্ছে নিশ্চিত লক্ষণ যে, যাকিছু পুণ্য করা হোক না কেন, সেগুলো দৃষ্টিভঙ্গি সোজাভাবের কারণে মহাফলদায়ক হয়।’
এই পুণ্যকাজগুলোর মধ্যে ‘দান দেব’ বলে চিন্তা করার সময়ে দানময় পুণ্যকাজ উৎপন্ন হয়, দান দেয়ার সময়ে এবং ‘দান দিয়েছি’ বলে পর্যালোচনা করার সময়েও দানময় পুণ্যকাজ উৎপন্ন হয়। এভাবে পূর্ববর্তী চেতনা, ত্যাগকালীন চেতনা এবং পরবর্তী চেতনা, এই তিন প্রকার চেতনাকে একত্রে ‘দানময় পুণ্যকাজ’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। শীলময় পুণ্যকাজও ‘শীল পূরণ করব’ চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, শীল পূরণকালে উৎপন্ন হয়, ‘আমার শীল পূরণ হয়েছে’ এভাবে পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘শীলময় পূণ্যকাজ’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। … দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী পুণ্যকাজও ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করব’ এমন চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, ‘আমি দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করেছি’ এমন পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী পুণ্যকাজ’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
সুত্রে কিন্তু কেবল তিন প্রকার পুণ্যকাজের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বাদবাকি পুণ্যকাজও অন্তর্ভুক্ত বলে বুঝতে হবে। সম্মান প্রদর্শন ও সেবার কাজগুলো শীলময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। পুণ্যদান, পুণ্য অনুমোদনের কাজগুলো দানময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। ধর্মদেশনা করা, ধর্মদেশনা শ্রবণ, দৃষ্টিভঙ্গি সোজাকারী কর্মগুলো ভাবনাময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। এভাবে এগুলো সংক্ষেপে তিনটি হলেও বিস্তারিতভাবে বললে দশটি পুণ্যকাজ হয়।
সেগুলোর মধ্যে ‘দান দেব’ চিন্তা করার সময়ে অাটটি কামাবচর কুশল চিত্তের যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, দান দেয়ার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা দান দেয়, দান পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে। ‘শীল পূরণ করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, শীল পূরণ করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পূরণ করে, ‘আমি শীল পূরণ করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে। ‘ভাবনা করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, ভাবনা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা ভাবনা করে, ‘আমি ভাবনা করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।
‘জ্যেষ্ঠদের সম্মান করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, সম্মান করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা করে, ‘আমি সম্মান করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’কায়িক সেবা করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, সেবা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা সেবা করে, ‘আমি কায়িক সেবা করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’পুণ্যদান করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, দান দেয়ার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পুণ্যদান দেয়, ‘আমি পুণ্যদান দিয়েছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’পুণ্য বা কুশলকাজের অনুমোদন করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, অনুমোদনের সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা অনুমোদন করে, ‘আমি অনুমোদন করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’ধর্মদেশনা করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, ধর্মদেশনা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা ধর্মদেশনা করে, ‘আমি ধর্মদেশনা করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’ধর্মশ্রবণ করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, ধর্মশ্রবণের সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা ধর্মদেশনা শোনে, ‘আমি ধর্মদেশনা শুনেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।’দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করব’ বলে চিন্তা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা চিন্তা করে, দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করে, ‘আমি দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করেছি’ বলে পর্যালোচনার সময়েও সেগুলোর যেকোনো একটি চিত্ত দ্বারা পর্যালোচনা করে।
এখানে চারটি অনন্তের কথাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চারটি অনন্ত রয়েছে- আকাশ অনন্ত, চক্রবাল বা মহাবিশ্বগুলো অনন্ত, সত্ত্বনিকায় বা প্রাণিজগত অনন্ত, বুদ্ধজ্ঞান অনন্ত। আকাশ পূর্বদিকে বা পশ্চিম দিকে বা উত্তর দিকে বা দক্ষিণ দিকে এত শতযোজন বা এত হাজার যোজন বিস্তৃত, এমন কোনো সীমা নেই। সিনেরুর মতো বিশাল লৌহপর্বত পৃথিবী চিরে নিচে ফেলে দিলে সেটা নিচে পড়তেই থাকবে, কোথাও ঠেকবে না, আকাশ হচ্ছে এমনই অনন্ত।
চক্রবাল বা মহাবিশ্বগুলোও এত শত বা এত হাজার বলে নির্দিষ্ট নেই। ধরা যাক, অকনিট্ঠ বা অকনিষ্ঠ ভবনে চারজন তীব্র গতিবেগসম্পন্ন মহাব্রহ্মা জন্মেছে। তারা কোনো এক শক্তিশালী ধনুর্বিদের হালকা তীর দ্বারা তির্যকভাব পড়ে থাকা তালছায়া অতিক্রমকালের মধ্যেই লক্ষ চক্রবাল বা লক্ষ মহাবিশ্ব পাড়ি দিতে সক্ষম। যদি তারা এমন গতিবেগ নিয়ে ‘মহাবিশ্বের শেষপ্রান্ত দেখব’ বলে প্রচণ্ডবেগে চলতে থাকে, তবুও মহাবিশ্বের শেষপ্রান্ত না দেখেই তারা পরিনির্বাপিত হবে, মহাবিশ্বগুলো এমনই অনন্ত।
এতগুলো মহাবিশ্বে জলে ও স্থলে থাকা প্রাণিরও কোনো সীমা নেই। প্রাণিজগত হচ্ছে এমনই অনন্ত। তার থেকেও অনন্ত হচ্ছে বুদ্ধজ্ঞান।
এমন অপরিমেয় মহাবিশ্বগুলোতে অপরিমেয় প্রাণিদের কামাবচর-খুশি সহকারে-জ্ঞানযুক্ত-অসংস্কারিক বা স্বতঃস্ফুর্ত-কুশল চিত্তগুলো এক একজনেরই বহুল পরিমাণে উৎপন্ন হয়ে থাকে। বহুজনের বহু উৎপন্ন হয়ে থাকে। সেগুলোকে কামাবচর হিসেবে, খুশি সহকারে হিসেবে, জ্ঞানযুক্ত হিসেবে, স্বতঃস্ফুর্ত হিসেবে একত্র করা যায়। খুশিসহকারে ত্রিহেতুক অসংস্কারিক বা স্বতঃস্ফুর্ত মহাচিত্ত কেবল একটিই হয়। সসংস্কারিক বা প্ররোচিত চিত্তও তেমনি … উপেক্ষাসহকারে জ্ঞানবিযুক্ত দ্বিহেতুক সসংস্কারিক বা প্ররোচিত চিত্তও হচ্ছে তেমনি একটিমাত্র। এভাবে অপরিমেয় মহাবিশ্বগুলোর অপরিমেয় প্রাণিদের মধ্যে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হতে থাকা কামাবচর কুশল চিত্তগুলোকে সম্যকসম্বুদ্ধ মহাদাঁড়িপাল্লা দিয়ে তুলনা করার মতো করে, পরিমাপ করার পাত্রে রেখে পরিমাপ করার মতো করে, সর্বজ্ঞতাজ্ঞান দ্বারা তাদের ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে ‘এগুলো সর্বমোট আটটি’ এভাবে সমগোত্রীয় হিসেবে আটটি অংশ করে দেখিয়েছেন।
আবার এই স্থানে ছয় প্রকার পুণ্যসঞ্চয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুণ্য স্বয়ংকৃত আছে, পরকৃত আছে, স্বহস্তকৃত আছে, আদিষ্ট আছে, সম্প্রজ্ঞানেকৃত আছে, অসম্প্রজ্ঞানেকৃতও আছে।
এগুলোর মধ্যে নিজের স্বভাববশত পুণ্য করলে সেটা হয় স্বয়ংকৃত। অন্যকে করতে দেখে করলে হয় পরকৃত। নিজ হাতে পুণ্য করলে হয় স্বহস্তেকৃত। আদেশ দিয়ে করালে সেটা হয় আদিষ্ট। কর্ম ও ফলের প্রতি বিশ্বাস রেখে পুণ্য করলে হয় সম্প্রজ্ঞানেকৃত । কর্ম ও ফলকে না জেনে করলে হয় অসম্প্রজ্ঞানেকৃত। এগুলোর মধ্যে স্বয়ংকৃত পুণ্যকাজ করার সময়ে আটটি কুশল চিত্তের কোনো একটি চিত্ত দ্বারা করে থাকে। পরকৃত পুণ্যকাজ করার সময়েও, স্বহস্তেকৃত পুণ্যকাজ করার সময়েও, আদিষ্ট পুণ্যকাজ করার সময়েও এই আটটি কুশল চিত্তের কোনো একটি চিত্ত দ্বারা করা হয়ে থাকে। তবে সম্প্রজ্ঞানে কৃত পুণ্যকাজ চারটি জ্ঞানযুক্ত চিত্তের কোনো একটি দ্বারা হয়। অসম্প্রজ্ঞানে কৃত পুণ্যকাজ চারটি জ্ঞানবিযুক্ত চিত্তের কোনো একটি দ্বারা হয়।
এই স্থানে অন্য চারটি দক্ষিণাবিশুদ্ধিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- দ্রব্যসামগ্রীর ধর্মসঙ্গততা, মহাচেতনা, ক্ষেত্রসম্পত্তি, অতিরিক্ত গুণ। ধর্মত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে পাওয়া দ্রব্যসামগ্রী হচ্ছে ধর্মসঙ্গত। বিশ্বাস করে শ্রদ্ধাভরে দিলে মহাচেতনা নাম হয়। আসবহীন অর্হৎ হলে তা হয় ক্ষেত্রসম্পত্তি। আসবহীন অর্হৎ ব্যক্তি নিরোধ ধ্যান থেকে উঠলে সেই অবস্থার নাম হয় অতিরিক্ত গুণ। এই চারটি গুণের সম্মিলন করে দান করতে সক্ষম হলে সেই কামাবচর কুশল পুণ্যকাজ এই ইহজন্মেই ফল দেয়। পুণ্ণক শ্রেষ্ঠী, কাকবলি, সুমন মালাকার ইত্যাদির মতো।
সংক্ষেপে এই সবগুলো কামাবচর কুশল চিত্তগুলোকে চিত্রিত করলে চিত্রবিচিত্রতার বিচারে সেগুলো একটিই হয়। বেদনার ভিত্তিতে হিসাব করলে খুশিসহকারে ও উপেক্ষা সহকারে দুধরনের হয়। জ্ঞানের বিভাজন দেখানোর ভিত্তিতে হয় চার প্রকার। খুশিসহকারে জ্ঞানযুক্ত স্বতঃস্ফুর্ত মহাচিত্ত এবং উপেক্ষাসহকারে জ্ঞানযুক্ত স্বতঃস্ফুর্ত মহাচিত্ত এদুটো জ্ঞানযুক্ত হিসেবে ও স্বতঃস্ফুর্ত হিসেবে একটিই হয়। তেমনি হচ্ছে জ্ঞানযুক্ত প্ররোচিত, জ্ঞানবিযুক্ত স্বতঃস্ফুর্ত, এবং জ্ঞানবিযুক্ত প্ররোচিত। এভাবে জ্ঞানের বিভাজন দেখানোর ভিত্তিতে চারটি স্বতঃস্ফুর্ত ও চারটি প্ররোচিত এই আটটি কুশল চিত্ত হয়। সেগুলোকে যথাযথভাবে জেনে গণশ্রেষ্ঠ, মুনিশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞ ভগবান সেগুলো ব্যাখ্যা করেন, দেশনা করেন, ঘোষণা করেন, প্রতিষ্ঠিত করেন, প্রকাশিত করেন, বিভাজিত করেন, স্পষ্ট করেন।
সাধু সাধু
সাধু সাধু সাধু