( সুত্রপিটক / ৩. সংযুক্ত নিকায় / ২.নিদানবর্গ / ৪. অনাদি সংযুক্ত / ২. দ্বিতীয় বর্গ / ১০. বিপুলপর্বত সুত্র)
১৪৩. এক সময় ভগবান রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। তখন ভগবান ভিক্ষুদেরকে আহ্বান করে বললেন, হে ভিক্ষুগণ। ভিক্ষুরা তখন প্রত্যুত্তর দিল, ভান্তে। ভগবান বললেন,
হে ভিক্ষুগণ, অনাদি এই সংসার। অবিদ্যার আবরণে ঢাকা, তৃষ্ণায় আবদ্ধ প্রাণিদের এই সংসারে ছুটে চলা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা দেখা যায় না।
হে ভিক্ষুগণ, অতীতে এই বিপুল পর্বতের নাম হয়েছিল ‘প্রাচীনবংশ‘। সেই সময়ে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে ডাকা হতো ‘তিবরা‘ নামে। তিবরা মানুষদের আয়ু ছিল চল্লিশ হাজার বছর। তিবরা মানুষেরা চারদিনে প্রাচীনবংশ পর্বতে উঠত, চারদিনে নামত। সেই সময়ে ককুসন্ধ ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। ককুসন্ধ ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধের বিধুর ও সঞ্জীব নামে প্রধান শিষ্যযুগল ছিল।
প্রাচীনবংশ পর্বতের উচ্চতা ছিল তখন চার যোজন বা ৪৮ কিলোমিটার। সেটাতে তিবরা মানুষেরা চারদিনে উঠত, চারদিনে নামত।
[[ বর্তমানে বিপুল পর্বতের নাম হচ্ছে বিপুলগিরি। ]]
দেখো হে ভিক্ষুগণ, এই পর্বতের সেই নামও এখন হারিয়ে গেছে, সেই মানুষেরাও মারা গেছে, সেই ভগবানও পরিনির্বাপিত হয়েছেন। সৃষ্টিগুলো এমনই অনিত্য। সৃষ্টিগুলো এমনই অধ্রুব। সৃষ্টিগুলো এমনই আশা-ভরসাহীন। তাই হে ভিক্ষুগণ, সকল সৃষ্টিগুলোতে বিতৃষ্ণ হওয়াই শ্রেয়, অনাসক্ত হওয়াই শ্রেয়, বিমুক্ত হওয়াই শ্রেয়।
হে ভিক্ষুগণ, অতীতে এই বিপুল পর্বতের নাম হয়েছিল ‘বঙ্কক‘। সেই সময়ে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে ডাকা হতো ‘রোহিতস্স‘ নামে। রোহিতস্স মানুষদের আয়ু ছিল ত্রিশ হাজার বছর। রোহিতস্স মানুষেরা তিনদিনে বঙ্কক পর্বতে উঠত, তিনদিনে নামত। সেই সময়ে কোণাগমন ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। কোণাগমন ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধের ভিয়্যো ও সউত্তর নামে প্রধান শিষ্যযুগল ছিল।
ককুসন্ধ ও কোণাগমন এই দুই বুদ্ধের মাঝে পৃথিবী নাকি এক যোজন বেড়েছিল। সেই এক বুদ্ধান্তর কল্পের মাঝে পর্বতের উচ্চতা কমে গিয়ে হয়েছিল তিন যোজন।
দেখো হে ভিক্ষুগণ, এই পর্বতের সেই নামও এখন হারিয়ে গেছে, সেই মানুষেরাও মারা গেছে, সেই ভগবানও পরিনির্বাপিত হয়েছেন। সৃষ্টিগুলো এমনই অনিত্য। সৃষ্টিগুলো এমনই অধ্রুব। সৃষ্টিগুলো এমনই আশা-ভরসাহীন। তাই হে ভিক্ষুগণ, সকল সৃষ্টিগুলোতে বিতৃষ্ণ হওয়াই শ্রেয়, অনাসক্ত হওয়াই শ্রেয়, বিমুক্ত হওয়াই শ্রেয়।
হে ভিক্ষুগণ, অতীতে এই বিপুল পর্বতের নাম হয়েছিল ‘সুপস্স‘। সেই সময়ে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে ডাকা হতো ‘সুপ্রিয়া‘ নামে। সুপ্রিয়া মানুষদের আয়ু ছিল বিশ হাজার বছর। সুপ্রিয়া মানুষেরা দুইদিনে বঙ্কক পর্বতে উঠত, দুইদিনে নামত। সেই সময়ে কশ্যপ ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। কশ্যপ ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধের তিষ্য ও ভারদ্বাজ নামে প্রধান শিষ্যযুগল ছিল।
দেখো হে ভিক্ষুগণ, এই পর্বতের সেই নামও এখন হারিয়ে গেছে, সেই মানুষেরাও মারা গেছে, সেই ভগবানও পরিনির্বাপিত হয়েছেন। সৃষ্টিগুলো এমনই অনিত্য। সৃষ্টিগুলো এমনই অধ্রুব। সৃষ্টিগুলো এমনই আশা-ভরসাহীন। তাই হে ভিক্ষুগণ, সকল সৃষ্টিগুলোতে বিতৃষ্ণ হওয়াই শ্রেয়, অনাসক্ত হওয়াই শ্রেয়, বিমুক্ত হওয়াই শ্রেয়।
হে ভিক্ষুগণ, বর্তমানে এই বিপুল পর্বতের নাম হয়েছে ‘বিপুল‘। বর্তমানে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে ডাকা হয় ‘মাগধী‘ নামে। মাগধী মানুষদের আয়ু হচ্ছে অল্প, কম, সামান্য। যে বেশি বাঁচে সে হয় একশ বছরের কম বা বেশি বাঁচে।
একশ বছরের কম বা বেশি বাঁচে মানে হচ্ছে একশ বছর থেকে সামান্য দশ বা বিশ বছর বেশি বাঁচে। একশ বছর পেরিয়ে আরো একশ বছর বাঁচবে এমন কেউ নেই। একশ পেরিয়ে বড়জোর আরো ষাট বা আশি বছর বাঁচে। একশ বছর না হতেই পাঁচ বছর, দশ বছর ইত্যাদি বয়সে মরে যায় বহুজন।
এখানে ককুসন্ধ ভগবান চল্লিশ হাজার বছর আয়ুকালে, কোণাগমন ভগবান ত্রিশহাজার বছর আয়ুকালে জন্মেছিলেন। এ থেকে মনে হয় যেন আয়ুষ্কাল ক্রমান্বয়ে কমেছে। আয়ুষ্কাল আসলে সেভাবে কমে না। বরং বেড়ে গিয়ে আবার কমে যায়। সেটা কীভাবে হয়?
ককুসন্ধ ভগবান এই কল্পেই চল্লিশ হাজার বছর আয়ুকালে জন্মেছিলেন। সেই আয়ুর পাঁচ ভাগের চার ভাগ [অর্থাৎ বত্রিশ হাজার বছর মাত্র] বেঁচে থেকে তিনি পরিনির্বাপিত হয়েছেন। সেই আয়ুকাল তখন থেকে কমতে কমতে দশবর্ষে নেমে আবার বেড়ে অসংখ্য বছরে উন্নীত হয়েছে। সেই অসংখ্য বছর থেকে আবার কমতে কমতে ত্রিশ হাজার বছর হলে তখন কোণাগমন বুদ্ধ জন্মেছিলেন। তিনিও সেভাবেই [পাঁচ ভাগের চার ভাগ মাত্র বেঁচে থেকে, অর্থাৎ চব্বিশ হাজার বছরে] পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। এরপর আবার আয়ুষ্কাল কমে এসেছিল দশ বছরে। সেখান থেকে আবার বেড়ে হয়েছিল অসংখ্য বছর। আবার তা কমে যখন বিশ হাজার বছর হয়েছিল তখন জন্মেছিলেন কশ্যপ বুদ্ধ। তিনিও সেভাবেই [অর্থাৎ ষোল হাজার বছরে] পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। সেই আয়ু কমে দশ বছর হয়ে আবার বেড়ে অসংখ্য বছর হয়েছিল। আবার তা কমে যখন একশ বছর হয়েছিল তখন আমাদের [গৌতম] সম্যক সম্বুদ্ধ জন্মেছিলেন। এভাবেই আয়ুষ্কাল ক্রমান্বয়ে কমে বাড়ে বলে বুঝতে হবে। যেই সময়ে আয়ুষ্কাল যত হয়, সেই সময়ে জন্মানো বুদ্ধগণের আয়ুও সেই পরিমাণে হয়।
[[ মানুষের আয়ুষ্কাল বা গড় বয়সের এই ওঠানামাটা ঠিক কী হারে হয় তা বলা কঠিন। তবে আমার একটা আইডিয়া আছে। আমাদের গৌতম বুদ্ধের আমলে মানুষের গড় আয়ু ছিল ১০০ বছর। আর বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু হয়েছে ৭৫ বছর। তার মানে এই ২৫০০ বছরে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২৫ বছর। অর্থাৎ প্রতি ১০০ বছরে মানুষের গড় আয়ু ১ বছর করে কমেছে। এখনো কমছে। এভাবে হিসাব করলে মানুষের গড় আয়ু কমতে কমতে ১০ বছরে পৌঁছাবে ভবিষ্যতের ৮৫২০ সালে।
]]
হে ভিক্ষুগণ, মাগধী মানুষেরা মুহুর্তের মধ্যে বিপুল পর্বতে ওঠে, মুহুর্তে নামে। বর্তমানে এই আমি হয়েছি ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ। আমার সারিপুত্র ও মোগ্গল্লায়ন নামে প্রধান শিষ্যযুগল হয়েছে।
হে ভিক্ষুগণ, সেই সময় আসবে যখন এই পর্বতের এই নাম হারিয়ে যাবে, এই মানুষেরাও মরে যাবে, আমিও পরিনির্বাপিত হব। হে ভিক্ষুগণ, সৃষ্টিগুলো এমনই অনিত্য। সৃষ্টিগুলো এমনই অধ্রুব। সৃষ্টিগুলো এমনই আশা-ভরসাহীন। তাই হে ভিক্ষুগণ, সকল সৃষ্টিগুলোতে বিতৃষ্ণ হওয়াই শ্রেয়, অনাসক্ত হওয়াই শ্রেয়, বিমুক্ত হওয়াই শ্রেয়।
ভগবান এই বলে এরপর এই গাথা বললেন,
তিবরাদের প্রাচীনবংশ,
রোহিতস্সাদের বঙ্কক,
সুপ্রিয়াদের সুপস্স,
মাগধীদের বিপুল পর্বত।
সৃষ্টিগুলো আসলেই অনিত্য,
উৎপত্তি ও বিলয়ধর্মী।
তারা উৎপন্ন হয়ে বিলীন হয়ে যায়।
তাদের উপশমই হচ্ছে সুখ।
বন্দনা ভান্তে ???
দুইটা প্রশ্ন জানার ইচ্ছা ছিল।
১. অসুরেরা যদি দেবতা হয় তাহলে তাদেরকে চারি অপায়ের শ্রেণীতে রাখা হয়েছে কেন?
২. কোনো ভিক্ষুকে যদি তার শিষ্য বা কেনো উপাসক ভিক্ষুটির ধ্যান সমাধি, মারর্গফল নিয়ে প্রশ্ন করে বা তার এরকম কিছু লাভ হয়েছে কি-না? আর ভিক্ষুটিও সেরকম কোনো কিছু লাভ করেনি। তারপরেও তিনি যদি লজ্জার কারণে বা লুকানোর জন্য তাদেরকে সারাসরি লাভ করিনি না বলে ঘুরিয়ে উত্তর দেন এভাবে, এই বিষয়ে গৃহি শ্রামণদের বলা ভিক্ষুদের নিষেধ। তাহলে সেই ভিক্ষুটির কি কোনো অপরাধ হবে?