Skip to content
Menu
ত্রিপিটক বাংলা অনুবাদ – জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু
MENUMENU
  • Home
  • বিনয়
    • পারাজিকা
      • পারাজিকা অধ্যায়
        • চতুর্থ পারাজিকা
  • সুত্র
    • অঙ্গুত্তর নিকায়
      • ৮ম নিপাত
        • গৃহপতি বর্গ
          • অক্ষণ সুত্র
    • খুদ্দক নিকায়
      • ২. ধর্মপদ
        • ২. অপ্রমাদ বর্গ
          • ৭. মঘের কাহিনী
        • ৮. সহস্র বর্গ
          • ৯. সংকিচ্চ শ্রামণের কাহিনী
        • ২৩. নাগ বর্গ
          • ৮. মারের কাহিনী
      • ৫. সুত্তনিপাত
        • ২. চূলবর্গ
  • অভিধর্ম
    • ধর্মসঙ্গণি
      • ১. চিত্তের উৎপত্তি অধ্যায়
        • কামাবচর কুশল পদগুলোর বিশ্লেষণ
  • অন্যান্য
    • অনাগতবংশ বাংলা অনুবাদ
  • বিশুদ্ধিমার্গ
  • বৌদ্ধ শব্দকোষ
ত্রিপিটক বাংলা অনুবাদ – জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু

৭. মঘের কাহিনী

Posted on October 16, 2019November 15, 2019
(সুত্রপিটক / ৫. খুদ্দকনিকায় / ২. ধর্মপদ / ২. অপ্রমাদ বর্গ / ৭. মঘের কাহিনী)
৩০. মাতাল হন নি বলে মঘবান1, দেবতাদের মধ্যে সেরা হতে পেরেছেন।
মাতাল না হওয়াটা প্রশংসনীয়, মাতাল হওয়াটা সর্বদা নিন্দনীয়।

—অর্থকথা ও টীকার ব্যাখ্যাবলী—

 

  1. মাতাল হন নি বলে মঘবান এই ধর্মদেশনা শাস্তা বৈশালীতে উঁচু চুড়াযুক্ত হলঘরে অবস্থানকালে দেবরাজ সক্ককে উপলক্ষ করে বলেছিলেন।

    বৈশালীতে মহালি নামের একজন লিচ্ছবি থাকত। সে তথাগতের সক্কপ্রশ্ন সুত্র দেশনা শুনে ভাবল, “সম্যকসম্বুদ্ধ সক্কের গুণের মহাপ্রশংসা করেছেন। সেটা কি তিনি দেখে বলেছেন নাকি নাদেখে বলেছেন? তিনি কি সক্ককে চেনেন নাকি চেনেন না? আমি বরং তাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব।” এই ভেবে মহালি লিচ্ছবি ভগবানের কাছে গিয়ে হাজির হল। ভগবানকে অভিবাদন জানিয়ে একপাশে বসল। একপাশে বসে মহালি লিচ্ছবি ভগবানকে জিজ্ঞেস করল, “ভান্তে কি দেবরাজ ইন্দ্র সক্ককে দেখেছেন?”
    “হ্যাঁ, মহালি। আমি দেবরাজ ইন্দ্র সক্ককে দেখেছি।”
    “ভান্তে, সেটা মনে হয় সক্কের রূপ ধরে থাকা অন্য কেউ হবে। কারণ দেবরাজ ইন্দ্র সক্ককে দেখতে পাওয়াটা খুবই কঠিন।”
    “সক্ককে আমি খুব ভালো করে চিনি, মহালি। সক্ক হওয়ার মতো বিষয়গুলো, অর্থাৎ যে যে বিষয়গুলো সম্পাদনের কারণে সক্ক তার এই অবস্থানে পৌঁছেছেন, সেটাও আমি ভালো করে জানি।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে মঘ নামের এক তরুণ হয়ে ছিল। তাই তাকে বলা হয় মঘবান।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে সবসময় আগে আগে দান দিত। তাই তাকে বলা হয় পুরিন্দদ বা পূর্বদাতা।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে সবসময় সযত্নে (সক্কচ্চং) দান দিত। তাই তাকে বলা হয় সক্ক বা যত্নকারী।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে সবসময় বাসস্থান দান দিত। তাই তাকে বলা হয় বাসব বা আবাসদায়ক।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক মুহর্তের মধ্যে হাজারো অর্থ চিন্তা করতে পারেন। তাই তাকে বলা হয় সহস্রাক্ষ।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক হচ্ছেন সুজা নামক অসুরকন্যার স্বামী। তাই তাকে বলা হয় সুজম্পতি।
    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক তাবতিংস দেবগণের অধিপতি হিসেবে রাজত্ব করেন। তাই তাকে বলা হয় দেবরাজ ইন্দ্র।

    দেবরাজ ইন্দ্রের সাতটি ব্রত

    দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে সাতটি ব্রত পালন করেছিলেন, যেগুলো করার কারণে তিনি এখন সক্ক হিসেবে অবস্থান করছেন। কোন সাতটি ব্রত? তিনি যাবজ্জীবন পিতামাতাকে ভরণপোষণ করেছেন। যাবজ্জীবন পরিবারের বড়দেরকে সম্মান করেছেন। যাবজ্জীবন কোমল সুরে কথা বলেছেন। যাবজ্জীবন পরচর্চা বা পরনিন্দা থেকে বিরত থেকেছেন। যাবজ্জীবন কৃপণতাহীন নির্মল মন নিয়ে সংসারে বসবাস করেছেন, নির্লোভ মনে, উদার হাতে, উৎসর্গে রত হয়ে, যে যা চায় তাকে তা দিয়ে নিত্য দানে নিরত হয়েছেন। যাবজ্জীবন সত্যবাদী হয়েছেন। যাবজ্জীবন অক্রুদ্ধ হয়ে থেকেছেন এই সংকল্প করে, “রেগে গেলেও যেন তাড়াতাড়ি শান্ত হতে পারি।” দেবরাজ ইন্দ্র সক্ক আগে মনুষ্যকুলে এই সাতটি ব্রত পালন করেছিলেন, যেগুলো করার কারণে তিনি এখন সক্ক হিসেবে অবস্থান করছেন।

    পিতামাতাকে ভরণপোষণকারী, পরিবারের বড়দেরকে সম্মানকারী,
    কোমল সুরে ভাষণকারী, পরনিন্দা পরিত্যাগকারী,
    কৃপণতাকে জয়ের প্রচেষ্টাকারী, সত্যবাদী, ক্রোধজয়ী ব্যক্তি,
    হে তাবতিংস দেবগণ, তাকেই বলা হয় সৎপুরুষ। (সং.নি.১.২৫৭)

    মহালি, এই হচ্ছে সক্কের মনুষ্যকুলে মঘ যুবক হিসেবে জন্মের সময়ে কৃতকর্ম। “

    তখন মহালি সেগুলো আরো বিস্তারিত করে শোনার উদ্দেশ্যে আবার জিজ্ঞেস করল, “ভান্তে, এই মঘ যুবক কীভাবে সেই ব্রতগুলো সম্পাদন করেছিল?” তখন শাস্তা অতীতের কাহিনী বলতে শুরু করলেন, “শোন তাহলে, মহালি!”

    মঘ যুবকের কাহিনী

    অতীতে মগধ রাজ্যের মচল গ্রামে মঘ নামের এক যুবক বাস করত। সে একবার গ্রামের কাজ করার স্থানে গিয়ে নিজে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই জায়গার ধুলোময়লা পা দিয়ে সাফ করে জায়গাটাকে সুন্দর করে তুলল। তখন আরেকজন তাকে ঠেলে দিয়ে সেই জায়গাটা নিজে দখল করে দাঁড়াল। সে রেগে না গিয়ে পাশের জায়গায় গিয়ে সেটা পরিষ্কার করে দাঁড়াল। কিন্তু আরেকজন এসে তাকে আবার হাতে ধরে সেখান থেকে ঠেলে দিয়ে সেই জায়গাটা দখল করে দাঁড়াল। সে তাতেও রাগল না। বরং অন্য জায়গায় গিয়ে সুন্দর করে জায়গাটা পরিষ্কার করে দাঁড়াল। এভাবে অন্যান্য লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে বার বার তার দাঁড়ানোর জায়গা থেকে হাতে ধরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে চিন্তা করল, “এরা সবাই আমার দ্বারা সুখী হয়েছে। এই কর্ম আমার ভবিষ্যতের জন্য সুখদায়ক পুণ্যকর্ম হবে।”

    সে পরদিন কোদাল নিয়ে ধান মাড়াইয়ের ক্ষেত্রের মতো স্থান পরিষ্কার করল। আবারো সবাই গিয়ে সেখানে দাঁড়াল। তখন সে তাদেরকে ঠাণ্ডার সময়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল। গরমের সময়ে তাদেরকে পানির ব্যবস্থা করে দিল। তখন তার মনে হলো, সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা সবার প্রিয়। এখন থেকে আমি রাস্তাঘাট সমান করে দেব। তখন থেকে সে সকালে বের হত, রাস্তাঘাট সমান করে দিয়ে, রাস্তার দুপাশের ডালপালা, ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে দিয়ে বেড়াত। তখন একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “বন্ধু, কী করছ?”
    “আরে বন্ধু, আমি স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা করছি।”
    “তাহলে বন্ধু, আমিও তোমার সাহায্যকারী হবো।”
    “হও বন্ধু। স্বর্গ হচ্ছে বহুজনের পছন্দের, সুখের স্থান।”

    তখন থেকে তারা দুজনে মিলে কাজ করত। তাদেরকে দেখে ব্যাপারটা পরস্পর জেনে একজন একজন করে যোগ দিয়ে তেত্রিশ জন হয়ে গেল। তারা সবাই মিলে কোদাল ইত্যাদি নিয়ে এক যোজন, দুই যোজন পর্যন্ত রাস্তা সমান করত।

    তাদেরকে দেখে গ্রামের মাতব্বর চিন্তা করল, এই লোকগুলো অনর্থক কাজ করছে। এরা যদি জঙ্গল থেকে মাছ মাংস শিকার করে আনত, অথবা মদ বানিয়ে খেত, অথবা সেরকম কোনো কাজ করত তাহলে আমারও কিছু না কিছু লাভ হত। তখন সে তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী করছ আজকাল?”
    “স্বর্গের রাস্তার কাজ করছি, প্রভু।”
    “গৃহী হয়ে থাকলে এমন কাজ করা শোভা পায় না। তোমরা জঙ্গল থেকে মাছ মাংস শিকার করে আনতে পার, মদ বানিয়ে খেতে পার, অথবা অন্য বহু ধরনের কাজ করতে পার।”

    তারা তার কথাগুলো আমলে নিল না। বার বার ডেকে বললেও শুনল না। মাতব্বর রেগেমেগে বলল, “তোদেরকে আমি শেষ করে ছাড়ব।” সে রাজার কাছে গিয়ে অভিযোগ দিল, “হে দেবতা, আমি ডাকাতদেরকে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।” রাজা আদেশ দিলেন, “যাও, তাদেরকে ধরে আন।” তখন সে গিয়ে তাদের সবাইকে বেঁধে এনে রাজার সামনে হাজির করাল। রাজা আর বিচারের ঝামেলায় গেলেন না। সোজা আদেশ দিলেন, “এদেরকে হাতি দিয়ে পিষ্ট করে মেরে ফেল।”

    মঘ তখন অন্যদেরকে উপদেশ দিল, “বন্ধুগণ, মৈত্রী ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় নেই। তোমরা সবাই কারোর প্রতি রাগ না করে রাজা, মাতব্বর ও হাতির প্রতি এবং নিজের প্রতিও সমানভাবে মৈত্রীভাব নিয়ে থাক।” তারা সেরকমই করল। তাদের মৈত্রীর প্রভাবে হাতি তাদের ধারেকাছেও যেতে পারল না। রাজা তা শুনে বললেন, ও আচ্ছা, বেশি লোকজন দেখে তাদেরকে পা দিয়ে পিষ্ট করতে ইতস্তত করছে? তাহলে যাও। তাদেরকে মাদুর দিয়ে ঢেকে রেখে পিষ্ট করাও। কিন্তু মাদুর দিয়ে ঢেকে দিলেও হাতি দূর থেকেই পিছিয়ে আসল।

    ব্যাপারটা শুনে রাজা ভাবলেন, এর কোনো একটা কারণ থাকবে নিশ্চয়ই। তিনি তাদেরকে ডাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বাপুরা, আমার আশ্রয়ে থেকে তোমাদের কী লাভ হচ্ছে না বলো তো?”
    “ব্যাপারটা কী, দেব?”
    “তোমরা নাকি দলবেঁধে ডাকাত হয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াও?”
    “কে এরকম বলেছে, দেব?”
    “গ্রামের মাতব্বর বলেছে।”
    “হে দেব, আমরা ডাকাত নই। আমরা নিজেদের স্বর্গের রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে এই এই কাজ করে থাকি। গ্রামের মাতব্বর আমাদেরকে পাপকাজগুলো করতে বললেও তার কথা না শোনায় সে আমাদেরকে শেষ করার ইচ্ছায় রেগেমেগে এরকম বলেছে।”

    রাজা তাদের কথা শুনে খুশি হয়ে বললেন, “বাপুরা, এই ইতর প্রাণি পর্যন্ত তোমাদের গুণ জানে। আমি মানুষ হয়ে জানতে পারি নি। ক্ষমা করো আমাকে।” এই বলে তিনি সেই মাতব্বর ও তার পুত্রকন্যাদেরকে মঘদের কাছে দাসগিরি করার আদেশ দিলেন। সেই হাতিও তাদেরকে দিয়ে দিলেন। সেই গ্রামও তাদেরকে দিয়ে দিলেন। তারা “এইজন্মেই আমাদের পুণ্যের ফল পেলাম!” এই বলে আরো বেশি খুশি হয়ে সেই হাতির পিঠে চড়ে যেতে লাগল। এভাবে পালাক্রমে হাতির পিঠে চড়ে যেতে যেতে তারা শলাপরামর্শ করতে লাগল, এখন তো আমাদের আরো বেশি পুণ্য করতে হবে। কী করা যায়? চৌরাস্তার মোড়ে জনগণের জন্য বড়সড় একটা বিশ্রামশালা বানাব। তারা কাঠমিস্ত্রি ডাকিয়ে সেই বিশ্রামশালা নির্মাণ করাল। তাদের স্ত্রীরা কিন্তু তাদের এসব উদ্ভট কর্মকাণ্ডে বেশ নাখোশ হয়েছিল। একারণে তারা স্ত্রীদেরকে এই বিশ্রামশালার কোনো কাজে জড়িত করল না।

    বিশ্রামশালা নির্মাণ

    এদিকে মঘের ঘরে চারজন স্ত্রী ছিল। তারা ছিল নন্দা, চিত্রা, সুধর্মা ও সুজা। এদের মধ্যে সুধর্মা সেই কাঠমিস্ত্রীর সাথে দেখা করে ঘুষ দিয়ে বলল, “ভাই, আমাকে এই বিশ্রামশালার প্রধান করে দাও।” কাঠমিস্ত্রি প্রতিশ্রুতি দিল। সে প্রথমেই কাঠ শুকিয়ে ছেঁচে কাটছাঁট করে বাড়ির ছাদের জন্য কড়িকাঠ বানিয়ে রাখল। সেই এরপর সে সেই কড়িকাঠের উপরে খোদাই করে লিখে দিল, “এই বাড়িটার নাম হচ্ছে সুধর্মা”। এরপর সেটাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখল।

    বিশ্রামশালা নির্মাণ শেষে এবার ছাদের কড়িকাঠ স্থাপনের পালা। সেদিন কাঠমিস্ত্রি বলল, “ও আর্যগণ, একটা কাজ করতে ভুলে গেছি।”
    “কী কাজ?”
    “কড়িকাঠ বানাতে ভুলে গেছি।”
    “ঠিক আছে। সেটা সংগ্রহ করা যাবে।”
    “এখন গাছ কাটলে সেটা দিয়ে হবে না। আগেই কেটে ছেঁচে কাটছাঁট করে রাখা কড়িকাঠের ব্যবস্থা করলে ভালো হবে।”
    “সেরকম কড়িকাঠ কোথায় পাওয়া যাবে?”
    “কারো ঘরে এভাবে বানিয়ে রাখা কড়িকাঠ পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখা দরকার।”

    তারা খুঁজতে খুঁজতে সুধর্মার ঘরে গিয়ে সেই বানিয়ে রাখা কড়িকাঠ দেখতে পেল। কিন্তু হাজারো মুদ্রার বিনিময়েও সুধর্মা সেটা বিক্রি করতে রাজি হল না। সে বলল, “আমাকে বিশ্রামশালার অংশীদার করলে তবেই দেব।” কিন্তু তারা বলল, “আমরা মেয়েদেরকে অংশীদার করি না।”

    তখন কাঠমিস্ত্রী বলে উঠল, “আর্যগণ, আপনারা কী বলছেন? ব্রহ্মলোক বাদে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে মেয়ে নেই। নিয়ে নিন ঐ কড়িকাঠ। সেটা হলে আমাদের কাজ শেষ করা যাবে।” তারা সেটা মেনে নিয়ে কড়িকাঠ নিয়ে বিশ্রামশালা নির্মাণকাজ সমাপ্ত করল। সেটাকে তারা তিনটা অংশে ভাগ করল। এক অংশ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জন্য, এক অংশ দুর্গত ব্যক্তিদের জন্য, আরেক অংশ হচ্ছে পীড়িতদের জন্য।

    তেত্রিশ জন সেখানে বসার জন্য তেত্রিশটা বসার জায়গা প্রস্তুত করে রাখল। এরপর তারা হাতিটাকে শিখিয়ে দিল, অতিথি এসে যার বানানো জায়গায় বসবে তার ঘরে নিয়ে যাবে। সেই অতিথির পা ডলে দেয়া, পিঠ ডলে দেয়া, পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য, শোয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি সবই সেই ঘরের মালিকের দায়িত্ব হয়ে যাবে। এভাবে হাতিটা আগন্তুকদেরকে বসার জায়গার মালিকদের ঘরে নিয়ে যেত। সেই জায়গার মালিক তখন আগন্তুকদেরকে সেদিনের জন্য দেখাশোনা করত।

    মঘ তখন সেই বিশ্রামশালার নিকটে একটা শ্বেতকাঞ্চন গাছ বপন করে তার গোড়ায় বসার জন্য সমতল পাথরের ফলক বসিয়ে দিল। বিশ্রামশালায় প্রবেশকালে লোকজন বাড়ির চুড়ায় তাকিয়ে লেখাটা পড়ত, “এই বাড়িটার নাম হচ্ছে সুধর্মা।” সেখানে তেত্রিশজনের নামগন্ধও নেই।

    নন্দা চিন্তা করল, এই বিশ্রামশালা করতে গিয়ে এরা আমাদেরকে অংশীদার করে নি। সুধর্মা চালাক হওয়ায় কড়িকাঠ বানিয়ে বিশ্রামশালার অংশীদার বনে গেছে। আমারও কিছু একটা করা দরকার। কী যে করি! হঠাৎ তার মনে পড়ল, বিশ্রামশালায় আসা লোকজনের তো খাওয়ার পানি, গোসলের পানি দরকার আছে। পুকুর খনন করে দেব একটা। সে পুকুর বানিয়ে দিল।

    চিত্রা চিন্তা করল, সুধর্মা কড়িকাঠ দিয়েছে। নন্দা পুকুর বানিয়ে দিয়েছে। আমারও কিছু একটা করা দরকার। কী করি! তখন তার মনে হলো, বিশ্রামশালায় আসা লোকজন পানি খেয়ে, গোসল করে যাওয়ার সময়ে ফুলের মালা দিয়ে সেজেগুজে গেলে ভালো হয়। তার জন্য ফুলের বাগান বানিয়ে দেব। সে মনোরম সুন্দর একটা ফুলের উদ্যান বানিয়ে দিল। সেখানে এত ধরনের ফুলফলের গাছ ছিল যে “এই ফুল বা ফলের গাছটা তো নেই” বলাটা মুশকিল হত।

    সুজা কিন্তু কিছুই করল না। সে ভাবল, আমি মঘের মামাতো বোন এবং স্ত্রী উভয়ই। তাই সে যা করেছে সেটা আমারই করার মতো হয়েছে। এই চিন্তা করে সে শুধু নিজের সাজগোজ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দিল। মঘ এদিকে পিতামাতার সেবা, পরিবারের বড়দেরকে সম্মান প্রদর্শন, সত্যবাদী, মিষ্টিবাক্য, পরনিন্দা থেকে বিরতি, কৃপণতা পরিত্যাগ, অক্রোধী এই সাতটি ব্রত পূরণ করতে থাকল সারা জীবন ধরে।

    পিতামাতাকে ভরণপোষণকারী, পরিবারের বড়দেরকে সম্মানকারী,
    কোমল সুরে ভাষণকারী, পরনিন্দা পরিত্যাগকারী,
    কৃপণতাকে জয়ের প্রচেষ্টাকারী, সত্যবাদী, ক্রোধজয়ী ব্যক্তি,
    হে তাবতিংস দেবগণ, তাকেই বলা হয় সৎপুরুষ। (সং.নি.১.২৫৭)

    তাদের পুণ্যের ফল

    সে এমন প্রশংসনীয় কাজ করে মরণের পরে তাবতিংস স্বর্গে সক্ক নামের দেবরাজা হয়ে জন্মাল। তার সহায়কেরাও মরণের পরে সেখানেই জন্মাল। কাঠমিস্ত্রি তখন বিশ্বকর্মা দেবপুত্র হয়ে জন্মাল।

    সেই সময়ে তাবতিংস স্বর্গীয় ভবনে অসুরেরা বাস করত। “নতুন নতুন দেবপুত্ররা এসেছেন” এই উপলক্ষে তারা দিব্য মদের আসর বসাল। দেবরাজ সক্ক তার লোকজনকে মদ না খাওয়ার সংকেত দিলেন। অসুরেরা এদিকে দিব্য পানীয় খেয়ে মাতাল হয়ে গেল। তখন সক্ক “এদের দিয়ে সাধারণভাবে রাজত্ব করে কী লাভ?” এই বলে তাদেরকে পায়ে ধরে মহাসাগরে ছুঁড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তারা উল্টে গিয়ে মহাসাগরে পড়ে গেল। অসুরেরা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হলো ঠিকই, কিন্তু তাদের পুণ্যবলে সিনেরু পর্বতের তলদেশে অসুরভবন দেখা দিল। গড়শিঙ্গা বৃক্ষ উৎপন্ন হলো।

    দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধের সময়ে অসুরেরা পরাজিত হলে তখন দশহাজার যোজন বিস্তৃত তাবতিংস দেবনগরী উৎপন্ন হলো। সেই নগরীর পূর্ব ও পশ্চিম গেটের মধ্যকার দূরত্ব ছিল দশহাজার যোজন। উত্তর ও দক্ষিণের গেটের মধ্যকার দূরত্বও ছিল দশহাজার যোজন। সেই নগরীতে এরকম হাজারটা গেট ছিল। সেই নগরীতে আরো ছিল উদ্যান ও পুকুর। আগের জন্মে বানিয়ে দেয়া বিশ্রামশালার পুণ্যফলে সেই নগরীর মধ্যভাগে উৎপন্ন হলো বৈজয়ন্ত নামের প্রাসাদ। সেই সপ্তরত্নময় প্রাসাদ ছিল সাতশ যোজন উঁচু। সেটি তিনশ যোজন উঁচু পতাকা দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল। সোনার খুঁটিগুলোতে ছিল মণিময় পতাকা। মণিময় খুঁটিগুলোতে ছিল স্বর্ণালী পতাকা। প্রবালের খুঁটিগুলোতে ছিল মুক্তার পতাকা। মুক্তার খুঁটিগুলোতে ছিল প্রবালের পতাকা। সপ্তরত্নময় খুঁটিগুলোতে ছিল সপ্তরত্নের পতাকা। মাঝখানে থাকা পতাকার উচ্চতা ছিল তিনশ যোজন।

    এভাবে বিশ্রামশালা নির্মাণজনিত পুণ্যফলে হাজার যোজন উঁচু প্রাসাদ সপ্তরত্ন সহকারে উৎপন্ন হলো। শ্বেতকাঞ্চন গাছ রোপণের ফলে তিনশ যোজন বেড়বিশিষ্ট পারিজাত বৃক্ষ উৎপন্ন হলো। শ্বেতকাঞ্চন গাছের গোড়ায় পাথরের বসার জায়গা বানিয়ে দেয়ার কারণে পারিজাত বৃক্ষের গোড়ায় উৎপন্ন হলো ষাট যোজন লম্বা, পঞ্চাশ যোজন প্রস্থ, পনের যোজন পুরু জবা ফুলের মতো লাল রঙের পাণ্ডুকম্বল শিলাসন উৎপন্ন হলো। সেখানে বসলে অর্ধেক শরীর ডুবে যায়। উঠলে আবার আগের মতো সমান হয়ে যায়।

    হাতিটা জন্মালো এরাবণ নামের দেবপুত্র হয়ে। দেবলোকে ইতর প্রাণি জন্মায় না। তবে সে উদ্যানে খেলতে নামলে নিজের দেহ বদলে দেড়শ যোজন উঁচু এরাবণ নামের হাতি হয়ে যায়। তেত্রিশজনের জন্য সে তেত্রিশটা হাঁড়ি নির্মাণ করে। সেগুলোর বেড় হয় তিন গাবুত কিংবা আধ যোজন। সবার মাঝখানে সক্কের জন্য নির্মাণ করে ত্রিশ যোজন বেড়বিশিষ্ট বড়সড় হাঁড়ি। তার উপরে থাকে বার যোজন বিস্তৃত রত্নময় মঞ্চ। তার মাঝে মাঝে থাকে সপ্তরত্নময় পতাকা, যেগুলো হয় যোজন পরিমাণ উঁচু। এর শেষ মাথায় ঝুলে থাকে টুংটাং শব্দওয়ালা ঘন্টাগুলো। মৃদু বাতাসে সেগুলো পঞ্চাঙ্গ তূর্যশব্দ মিশ্রিত দিব্যগীতের শব্দের মতো শব্দ করে। মঞ্চের মাঝে সক্কের জন্য যোজন বিস্তৃত মণিপালঙ্ক থাকে। সক্ক সেখানে বসেন। তেত্রিশজন দেবপুত্র নিজ নিজ হাঁড়িতে রত্নময় পালঙ্কে বসেন। তেত্রিশজনের জন্য প্রত্যেকটি হাঁড়িতে সাতটা সাতটা করে দাঁত বানিয়ে দেয়। সেগুলোর একেকটি হয় পঞ্চাশ যোজন বিস্তৃত। একেকটি দাঁতে সাতটি করে পুকুর থাকে। একেকটি পুকুরে থাকে সাতটি করে পদ্মগুচ্ছ। একেকটি পদ্মগুচ্ছে থাকে সাতটি করে পদ্মফুল। একেকটি ফুলে থাকে সাতটি করে পাপড়ি। একেকটি পাপড়িতে সাতজন করে দেবকন্যা নাচতে থাকে। এভাবে পঞ্চাশ যোজন স্থানে হাতির দাঁতগুলোর উপরে নাচগানের উৎসব চলতে থাকে। এমন মহাযশ উপভোগ করতে করতে দেবরাজ সক্ক বিচরণ করে থাকেন।

    সুধর্মাও মরণের পরে সেখানেই জন্মাল। তার সুধর্মা নামে নয়শ যোজন বিস্তৃত দেবসভা উৎপন্ন হলো। এর থেকে সুন্দর জায়গা নাকি অন্যকোথাও নেই। মাসের আটদিন সেখানে ধর্মশ্রবণ অনুষ্ঠান চলে। একারণেই বর্তমানেও কোনো সুন্দর জায়গা দেখলে নাকি “সুধর্মা দেবসভার মতো” বলে লোকজন বলাবলি করে।

    নন্দাও মরণের পরে সেখানে জন্মাল। তার পাঁচশ যোজন বিস্তৃত নন্দা নামের সরোবর উৎপন্ন হলো।

    চিত্রা মরণের পরে সেখানে জন্মাল। তার জন্য পাঁচশ যোজন বিস্তৃত চিত্রলতাবন উৎপন্ন হলো। দেবপুত্রদের মরণের সময় ঘনিয়ে আসলে কয়েকটা লক্ষণ দেখা দেয়। তখন তাদেরকে এই চিত্রলতাবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সেখানে প্রবেশ করলে মরণের শোক ভুলে গিয়ে বনের শোভায় মোহিত হয়ে উপভোগ করতে থাকে।

    সুজা কিন্তু মরণের পরে এক পাহাড়ের খাদে একাকী বকী (মেয়ে বক) হয়ে জন্মাল। সক্ক তার স্ত্রীদের কে কোথায় আছে দেখতে গিয়ে দেখলেন, সুধর্মা এখানেই জন্মেছে। নন্দা এবং চিত্রাও এখানে আছে। সুজা কোথায় গেল? চিন্তা করে দেখতে পেলেন বকী হয়ে জন্মেছে। “মুর্খ কোথাকার! কোনো পুণ্য না করে এখন ইতর প্রাণি হয়ে জন্মেছে। তাকে পুণ্য করিয়ে এখানে আনা দরকার।” এই ভেবে তিনি অচেনা বেশে বকীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কী করে আছ?”
    “প্রভু, আপনি কে?”
    “আমি তোমার স্বামী মঘ।”
    “কোথায় জন্মেছেন স্বামী?”
    “আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছি। তোমার বান্ধবীরা কোথায় জন্মেছে জান কি?”
    “জানি না, স্বামী।”
    “তারাও আমার কাছেই জন্মেছে। তাদেরকে দেখবে?”
    “আমি কীভাবে সেখানে যাব?”
    “আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব।”

    এই বলে সক্ক বকীকে হাতের উপরে রেখে দেবলোকে নিয়ে গেলেন। সেখানে বকীটাকে নন্দা সরোবরের পাড়ে রেখে দিয়ে অন্য তিনজনকে বললেন, “তোমাদের বান্ধবী সুজাকে দেখবে?”
    “কোথায় সে, দেব?”
    “নন্দা পাড়ে।”
    তারা তিনজন গিয়ে তাকে দেখে উপহাস করে বলল, “আহা, আর্য্যার এমন সাজগোজের এই ফল! এখন তার ঠোঁট দেখ, পাগুলো দেখ, হাঁটু দেখ। সে তো দেখছি বেশ সুন্দরই হয়েছে!” এভাবে উপহাস করে তারা চলে গেল।

    সক্ক আবার বকীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বান্ধবীদের সাথে দেখা হয়েছে?”
    “দেখা হয়েছে। তারা আমাকে উপহাস করে চলে গেছে। এবার আমাকে আমার জায়গায় নিয়ে চলো।”
    সক্ক তাকে আগের জায়গায় নিয়ে গিয়ে পানিতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তাদের ভোগসম্পত্তি দেখেছ তো?”
    “দেখেছি, দেব।”
    “তোমারও সেখানে জন্মানোর একটা উপায় করা দরকার।”
    “আমি কী করব, দেব?”
    “আমার উপদেশ রাখবে?”
    “রাখব, দেব।”

    সুজার পঞ্চশীল পালন

    তখন সক্ক তাকে পঞ্চশীল দিয়ে উপদেশ দিলেন, “মনোযোগ দিয়ে এগুলো পালন করবে।” এভাবে উপদেশ দিয়ে তিনি চলে গেলেন। সেই থেকে বকী কেবল মৃত মাছ খুঁজে নিয়ে খেত। সক্ক কয়েকদিন পরে তাকে পরীক্ষা করার জন্য সেখানে গিয়ে বালুচরে মরা মাছের রূপ ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলেন। বকী সেটা দেখে মরা মাছ মনে করে তুলে নিল। কিন্তু গিলে ফেলার সময়ে মাছের লেজটুকু নড়ে উঠল। বকী তখন জ্যান্ত মাছ মনে করে তাড়াতাড়ি সেটাকে পানিতে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে সক্ক আবার মরা মাছের মতো হয়ে বকীর সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলেন। বকী আবার তাকে মরা মাছ মনে করে ধরে গিলতে শুরু করল। কিন্তু লেজ নড়ে উঠতেই জ্যান্ত মাছ বলে আবার ছেড়ে দিল। এভাবে তিনবার পরীক্ষা করার পরে সক্ক বুঝতে পারলেন, বকী সুন্দরভাবে শীল রক্ষা করছে। তখন তিনি নিজের পরিচয় জানিয়ে, “আমি তোমাকে পরীক্ষার জন্য এসেছিলাম। তুমি সুন্দর করে শীল রক্ষা করেছ। এভাবে শীল রাখলে তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে জন্মাতে পারবে। তাই মনোযোগী হও।” এই বলে চলে গেলেন।

    সেই থেকে বকী কখনো মরা মাছ পেত, কখনো পেত না। খেতে না পেয়ে সে কয়েকদিনের মধ্যে শুকিয়ে মারা গেল। তার শীলের ফলে সে বারাণসিতে কুমোরপাড়ায় এক কুমোরের কন্যা হিসেবে জন্মাল। তার পনের ষোল বছরের সময়ে সক্ক চিন্তা করে দেখলেন কোথায় জন্মেছে সে। বারাণসিতে জন্মেছে দেখে তিনি ভাবলেন এবার তার যাওয়া দরকার। তিনি সপ্তরত্নকে শসার মতো করে দেখিয়ে সেগুলো দিয়ে গাড়ি পূর্ণ করে সেই গাড়ি চালিয়ে বারাণসির পথে পথে ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন, “মা-বাবাগণ, শসা নিন, শসা নিন।” শসার বদলে মুগডাল, মাসকলাই ইত্যাদি বিনিময়ের জন্য আসা লোকজনকে তিনি জানিয়ে দিলেন, “আমি কোনো মূল্যের বিনিময়ে এগুলো দিই না।”
    “তাহলে কীভাবে দাও?”
    “আমি এগুলো শীল রক্ষাকারী মেয়েদেরকে দিই।”
    “শীল জিনিসটা কী, বাপু? সেটা কোন ধরনের? সেটা কি কালো, নাকি নীল ইত্যাদি রঙের?”
    “আপনারা শীল কোন ধরনের সেটাও জানেন না। তাহলে কীভাবে সেটা রক্ষা করবেন? আমি এগুলো কেবল শীল রক্ষাকারীকে দিয়ে থাকি।”
    “বাপু, এই কুমোরকন্যা তো ‘আমি শীল রক্ষা করি’ বলে বলে বেড়ায়। তাহলে তাকেই দিয়ে দাও শসাগুলো।”
    কুমোরকন্যাও বলল, “তাহলে আমাকে দাও, প্রভু।”
    “তুমি কী?”
    “আমি সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করি।”
    “তোমার জন্যই আমি এগুলো এনেছি।” এই বলে গাড়ি চালিয়ে তার ঘরে গিয়ে সেই শসার মতো করে দেখানো দিব্যধনগুলো তাকে দিয়ে অন্যরা যাতে সেগুলো কোনোভাবে হরণ করে নিতে না পারে সেই ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “এটা তোমার জীবন যাপনের ধন। পঞ্চশীল অখণ্ডভাবে রক্ষা করো।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।

    মেয়েটি সেই জন্মে মরণের পরে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতিপক্ষ অসুরভবনে অসুররাজার পরিবারে বড় কন্যা হিসেবে জন্মাল। পরপর দুই জন্ম ধরে শীল সুন্দরভাবে রক্ষা করার কারণে সে হয়েছিল অত্যন্ত সুন্দরী, যেন সোনার প্রতিমা, অসাধারণ রূপশ্রী তার। অসুররাজ বেপচিত্তি সেখানে আগত অসুরদের কারো কাছে তার কন্যা সমর্পণ করলেন না। তিনি বললেন, “তোমরা আমার কন্যার উপযুক্ত নও।” তিনি চিন্তা করলেন, আমার কন্যা নিজেই নিজের উপযুক্ত স্বামী বেছে নেবে। তাই তিনি অসুরদের দলকে ডেকে কন্যার হাতে ফুলের মালা তুলে দিয়ে বললেন, “তোমার উপযুক্ত স্বামী বেছে নাও।”

    সেই সময়ে সক্ক সে কোথায় জন্মেছে দেখতে গিয়ে ব্যাপারটা জেনে ভাবলেন, “এখন তো সেখানে গিয়ে তাকে আমার এখানে আনা দরকার।” এই ভেবে তিনি বুড়ো এক অসুরের রূপ ধারণ করে লোকজনের শেষপ্রান্তে দাঁড়ালেন। অসুরকন্যাও এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বুড়োরূপী সক্ককে দেখামাত্র আগের জন্মে একসাথে বসবাসের কারণে মনে যেন সহসা প্রেমের বান উথলে উঠল। সে “এই হচ্ছে আমার স্বামী” এই বলে তার উপরে ফুলের মালা ছুঁড়ে দিল। অসুরেরা “আমাদের রাজা এতকাল তার কন্যার যোগ্য পাত্র পান নি। এখন যাকে পেলেন সে তো এই কন্যার দাদুর থেকেও বুড়ো মনে হয়।” এই বলে লজ্জা পেয়ে চলে গেল।

    সক্ক অসুরকন্যার হাত ধরে “আমি সক্ক” বলে ঘোষণা করে আকাশে উঠে গেলেন। অসুরেরা তা শুনে “বুড়ো সক্ক আমাদেরকে ঠকিয়ে গেল” বলে তার পিছু ধাওয়া করল। এদিকে সারথি মাতলি তখন বৈজয়ন্ত রথ নিয়ে মাঝপথে অপেক্ষা করছিল। সক্ক অসুরকন্যাকে রথে উঠিয়ে দেবনগরীর অভিমুখে রওনা দিলেন। মাঝপথে শিমুলবনে পৌঁছলে রথের শব্দ শুনে গরুড় পাখির ছানাগুলো ভয়ে চীৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। তাদের শব্দ শুনে সক্ক মাতলিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা কাঁদছে?”
    “গরুড় পাখির ছানাগুলো, দেব।”
    “কী কারণে কাঁদছে?”
    “রথের শব্দ শুনে মরণভয়ে কাঁদছে।”
    “আমার একজনের কারণে এতগুলো পাখি রথের প্রচণ্ড গতির তোড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে নষ্ট না হোক। রথ ফেরাও।”

    সারথি মাতলি তখন হাজারো সিন্ধব ঘোড়াকে লাঠির মাধ্যমে সংকেত দিয়ে রথ ফেরাল। তা দেখে অসুরেরা ভাবল, বুড়ো সক্ক অসুরপুর থেকে পালাতে পালাতে এখন রথ ঘুরিয়েছেন। নিশ্চয়ই তার সাহায্যকারী সেনারা এসে গেছে। এই ভেবে তারা যে পথে এসেছিল সেই পথেই অসুরপুরে ফিরে গিয়ে আর মাথা তোলার সাহস পেল না।

    সক্কও অসুরকন্যা সুজাকে দেবনগরীতে নিয়ে গিয়ে আড়াই কোটি অপ্সরাদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রেখে দিলেন। সুজা বর প্রার্থনা করল, “মহারাজ, আমার এই দেবলোকে মা-বাবা অথবা ভাই বোন কিছুই নেই। আপনি যেখানে যেখানে যাবেন সেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন।” সক্কও নিয়ে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।

    সেই থেকে গড়শিঙ্গা ফুল ফুটতে শুরু করলে অসুরেরা “আমাদের জন্মস্থানে দিব্য পারিজাত ফুল ফোটার সময় হয়েছে” বলে যুদ্ধের জন্য স্বর্গে উঠতে শুরু করে। তাদের প্রতিরোধের জন্য সক্ক নিচের সমুদ্রে নাগদেরকে বসিয়ে দিয়েছেন। এর উপরে সুপর্ণদেরকে। এর উপরে কুম্ভণ্ডদেরকে। এর উপরে যক্ষদেরকে। এরপরে চারি মহারাজাকে। সবার উপরে উপদ্রব নিবারণের জন্য দেবনগরীর গেটগুলোতে বজ্র হাতে নিয়ে থাকা ইন্দ্রের প্রতিমা স্থাপন করে রেখেছেন।

    অসুরেরা নাগ ইত্যাদিদেরকে জয় করে অগ্রসর হলেও দূর থেকে ইন্দ্রের মূর্তি দেখেই “সক্ক বের হয়েছেন রে!” বলে ভয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে মাতাল না হয়ে তিনি এভাবে আধিপত্য লাভ করে দুই দেবলোকে রাজত্ব করেন। এভাবে অপ্রমাদ বা মাতাল না হওয়াটা বুদ্ধগণের প্রশংসনীয়। এই অপ্রমাদ বা মাতাল না হওয়াকে ভিত্তি করে লৌকিক ও লোকোত্তর সবকিছু অর্জন করা যায়। এই বলে বুদ্ধ তখন এই গাথা বললেন,

    ৩০.  মাতাল হন নি বলে মঘবান, দেবতাদের মধ্যে সেরা হতে পেরেছেন।
         মাতাল না হওয়াটা প্রশংসনীয়, মাতাল হওয়াটা সর্বদা নিন্দনীয়।

    এখানে মাতাল হন নি বলে মানে হচ্ছে মচল গ্রামে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে মাতাল না হয়ে কৃত কাজগুলোর মাধ্যমে। মঘবান মানে হচ্ছে বর্তমানে মঘবান নামে পরিচিত অতীত জন্মের মঘ নামের যুবকটি, যিনি দুই দেবলোকের রাজা হওয়ার কারণে দেবতাদের মধ্যে সেরা হতে পেরেছেন। প্রশংসনীয় মানে হচ্ছে বুদ্ধ ইত্যাদি পণ্ডিতগণ অপ্রমাদ বা মাতাল না হওয়াটাকেই প্রশংসা করেন, গুণগান করেন। কী কারণে? লৌকিক ও লোকোত্তর বিষয়গুলো লাভ করা যায় বলে। মাতাল হওয়াটা সর্বদা নিন্দনীয় মানে হচ্ছে প্রমাদ বা মাতাল হওয়াটা আর্যগণের নিত্য নিন্দিত। কী কারণে? সকল প্রকার পরিহানির মূল কারণ হয় বলে। মানুষ হয়েও দুর্গত অবস্থায় পড়া, অথবা অপায় বা দুঃখময় ভূমিতে জন্মানো ইত্যাদি সবই হচ্ছে প্রমাদ বা মাতাল হওয়ার কারণে।

    গাথা শেষে মহালি লিচ্ছবি স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হল। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বহু লোক স্রোতাপন্ন ইত্যাদি হয়ে গেল।

2 thoughts on “৭. মঘের কাহিনী”

  1. অর্পন বড়ুয়া says:
    July 9, 2020 at 4:55 pm

    সাধু সাধু সাধু

    Reply
  2. কিশোর কুমার মুৎসুদ্দি says:
    January 25, 2021 at 9:22 pm

    সাধু সাধু সাধু

    Reply

Leave a Reply to অর্পন বড়ুয়া Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই সাইটে সার্চ করুন

ত্রিপিটক ও অন্যান্য

        • চতুর্থ পারাজিকা
    • পাচিত্তিয়
          • ১. ইন্দক সুত্র
            • ১০. বিপুলপর্বত সুত্র
            • ১. প্রথম কোটিগ্রাম সুত্র
            • ৪. কূটাগার সুত্র
          • অক্ষণ সুত্র
          • ৪. দীর্ঘজাণু সুত্র
          • ৭. মঘের কাহিনী
          • ৯. সংকিচ্চ শ্রামণের কাহিনী
          • ৮. মারের কাহিনী
          • ২. আমগন্ধ সুত্র
        • কামাবচর কুশল পদগুলোর বিশ্লেষণ
    • অনাগতবংশ বাংলা অনুবাদ

নতুন শব্দগুলো

  • সিরীস August 23, 2020
  • মল্লিকা August 22, 2020
  • সিন্দুৰার August 22, 2020
  • কুমুদ August 22, 2020
  • কুন্দ August 22, 2020

নতুন পোস্টগুলো

  • ভীরুতা সুত্র March 24, 2021
  • Declension of Pāli Nouns, Pronouns and Adjectives February 22, 2020
  • Conjugation of Pāli Verbs February 22, 2020
  • পালি গ্রন্থাবলীর ইতিহাস – ২. গ্রন্থকার পরিচিতি February 2, 2020
  • পালি গ্রন্থাবলীর ইতিহাস – ১. ত্রিপিটক পরিচিতি February 1, 2020

সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো

  • কিশোর কুমার মুৎসুদ্দি on ৭. মঘের কাহিনী
  • Apan chakma on কামাবচর কুশল পদগুলোর বিশ্লেষণ
  • অর্পন বড়ুয়া on ২. আমগন্ধ সুত্র
  • অর্পন বড়ুয়া on ৭. মঘের কাহিনী
  • ছদক চাকমা on বিপুলপর্বত সুত্র

পোস্টের তালিকা

  • ▼2021 (1)
    • ►March (1)
  • ►2020 (8)
    • ►February (4)
    • ►January (4)
  • ►2019 (9)
    • ►December (1)
    • ►November (1)
    • ►October (7)

ট্যাগ

অঙ্গুত্তর নিকায় (1) আয়ুকল্প (1) ইন্দ্রকূট (1) কক্করপত্র (1) কোলিয় (1) গৃহীজীবন (1) গড় আয়ু (1) দীর্ঘজাণু (1) পঞ্চক নিপাত (1) বুদ্ধান্তর কল্প (1) ব্যগ্ঘপজ্জ (1) ভ্রুণের ক্রমবিকাশ (1) মাতৃগর্ভ (1) যক্ষ (1) রাজগৃহ (2) সুত্র (1)
©2021 ত্রিপিটক বাংলা অনুবাদ – জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু | Powered by WordPress and Superb Themes!